অলিম্পিয়াড পিনবোর্ডের পেছনের গল্প

২০১৫ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাস। জেলা শিক্ষা অফিস থেকে স্কুলে চিঠি এলো, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের নাম পাঠানোর জন্য। একটা দিন ক্লাসে থাকা লাগবেনা, স্কুলের বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়া যাবে, আনন্দেই নাম দিয়ে দিলাম। যথারীতি হাসতে হাসতে চলে গেলাম, বাছাই পর্বের প্রোগ্রামে। নিজের বন্ধু কিংবা স্কুলের মানুষদের সাথে কম আর অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে বেশি আড্ডা দিলাম। অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হলাম। পরিচয় হলো জয়দীপের সাথে, যে চোখের পলকেই যেকোনো জ্যমিতির সমস্যা সমাধান করতে পারে। পরবর্তীতে এই ছেলে ইরানিয়ান জ্যমিতি অলিম্পিয়াডে সারা পৃথিবীর ৫৯ টি দেশের বাছাইকৃত সেরাদের সেরা শিক্ষার্থীদের মাঝে পার্ফেক্ট স্কোর করে প্রথম হয়েছে এবং স্বর্ণ পদক অর্জন করেছে । ওর মুখ থেকেই প্রথম শুনলাম গণিত অলিম্পিয়াড নামের একটা প্রোগ্রাম হয় দেশে। যেখানে সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। সেখানে পরীক্ষা কম, আনন্দ বেশি করা যায়, সেজন্য এটার জাতীয় পর্বের নামই রাখা হয়েছে গণিত উৎসব। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে কোনো অর্জন ছিলোনা।
বাসায় গিয়ে গণিত উৎসব নিয়ে ঘাটলাম, দেখলাম সেবছরের সব আয়োজন প্রায় শেষ। পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করা লাগবে।  তখনকার সময়ে আমার ঘাটাঘাটি বলতে, ওই ফেসবুকের সার্চ অপশন পর্যন্তই ছিলো।
ফেসবুক থেকে দেখে পরের আয়োজনে রেজিস্ট্রেশন করেই ফেললাম। এবার আর সৃজনশীল প্রোগ্রামের মতো খালি হাতে ফিরতে ইচ্ছে ছিলোনা। সেজন্য, যাকেই পাচ্ছিলাম, তার কাছেই জানতে চাচ্ছিলাম, প্রস্তুতি কিভাবে নিবো। জানেনা। কেউ জানেনা। কেউ কিছু বলতে পারলোনা। ঠিকভাবে গুগল ব্যবহারটাও ত জানা ছিলোনা , তাই ইন্টারনেট থেকেও খুজে বের করতে পারিনি , কিভাবে প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আবারো পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় খুব খারাপ ফলাফল। আগেরবার কোনো আশা ছিলোনা, গিয়েছিলাম আনন্দ করতে, তাই দুঃখবোধও ছিলোনা। কিন্তু এবার শুধুমাত্র গাইডলাইনের অভাবে, খারাপ ফলাফল এলো, মন খারাপ হলো।
পরেরবছর কলেজে উঠে গেলাম, ততদিনে গুগল করতেও শিখে গেলাম, ইন্টারনেট থেকে ঘেটে ঘেটে অনেককিছু জানলাম, শিখলাম। ঢাকার রামানুজন ম্যাথ ক্লাবেও ক্লাস করলাম। তখন জানা ছিলো কি করা লাগবে, কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে কিন্তু তখন সময় ছিলোনা। কলেজের এতো এতো পড়া আর উদ্ভাসের নিয়মিত এক্সামের চাপে সময় বের করতেই পারছিলাম না। নিজেকে দিয়ে আর আশা নেই জেনেও , কলেজ লাইফে দেশের সব বড় বড় আয়োজনে ছুটে গিয়েছিলাম শুধু দেখতে , যারা স্কুল লাইফেই এধরণের আয়োজনে ভালো ফলাফল করে, দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য বয়ে আনে, তারা কিভাবে পারে। এসবের মাঝে কেবল ন্যাশনাল এস্ট্রোনমি অলিম্পিয়াডে আঞ্চলিকে বিজয়ী হয়ে জাতীয় পর্বে সুযোগ পেয়ে গেলাম। এছাড়া কলেজ লাইফে এতো দৌড়াদৌড়ির অর্জন বলতে, দেশের অনেক বড় বড় কমিউনিটিগুলোতে যুক্ত হতে পারা, আর অন্যরা কেন সফল হয় সেটা জানতে  পারা।
যারা এধরণের বুদ্ধিভিত্তিক আয়োজনে সফল হয়, তারা তথ্যপ্রাপ্তির দিক থেকে প্রিভিলেজ। তথ্যপ্রাপ্তি , দিক নির্দেষণা পাওয়া এই ব্যপারগুলোর জন্য তাদের হন্যে হয়ে এখান থেকে ওখানে ছুটতে হয়না। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সব রকম ব্যবস্থা থাকে। যাদের সেটা নেই, তাদের স্থানীয় বিজ্ঞান ক্লাব থেকে সম্পূর্ণ সহায়তা পায়।
সেখান থেকেই ভাবনাটা প্রথম মাথায় এলো।
আমরা ঠিক যেখানে ব্যর্থ হয়েছি, আমার এলাকার কিংবা আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর কেউ যেনো সেই একই জায়গায় ব্যর্থ না হয়, সেজন্য বন্ধু ইমন আর তানজিরের সাথে আলাপ আলোচনা করে শুরু করলাম, টিম ফাইন পাই। স্কুলের সবচেয়ে আপন শিক্ষক, শাওন স্যরের সাথে কথা বলে, উনার ব্যচের শিক্ষার্থীদের এসব আয়োজনের সাথে পরিচিত করানো, সেখান থেকে আগ্রহীদের ট্রেইন করা শুরু করলাম। সেবছর বাছাই গণিত অলিম্পিয়াড পার হয়ে অনেকেই আঞ্চলিক পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে গেলো। করোনার কারণে, সবগুলো পর্বই অনলাইনে আয়োজিত হচ্ছিলো। প্রথমবার হিসাবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ওই আঞ্চলিক পর্যন্তই ছিলো কিন্তু আমাদের স্কুলের ক্লাস সিক্সের একজন শিক্ষার্থী, আমাদের অবাক করে দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেলো। ফলাফল দেখার পর কিছুক্ষণ নির্বাক ছিলাম আমরা। মনে হচ্ছিলো, এভাবেই হবে। আমাদের উদ্যোম বেড়ে গেলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখতে পেলাম, শুধু আমাদের স্কুল বা এলাকা নয়। দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রিভিলেজ না। তারা না পাচ্ছে নিয়মিত আয়োজন খবরগুলো আর না পাচ্ছে কোনো ধরণের দিকনির্দেশনা। এবার আরেকটু বড় স্বপ্ন দেখার সাহস হলো। আবারো আমরা তিনজন মিলে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলাম, আমাদের অফলাইন আয়োজনগুলো এলাকাতে সীমাবদ্ধ্ব থাকলেও, আমাদের অনলাইনে আরো বেশি শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য কাজ করা উচিত।  সেই ভাবনা থেকেই শুরু হলো অলিম্পিয়াড পিনবোর্ড নামক পেজের।
আজ সেই পেজে তিন হাজারতম ফলোয়ার যুক্ত হলো। যেখানে মিম পেজে হাজার হাজার ফলোয়ার এক দিনে যুক্ত হচ্ছে, সেখানে এডুকেশনাল কন্সাল্টেন্সির পেজে তিন হাজার সংখ্যার দিক থেকে অনেক কম, আর সেটা যদি চিন্তা করা হয়, সময়ের হিসাবে, তাহলে এটা নিতান্তই কম। কিন্তু তারপরেও এটা আমাদের আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায় আরেকটু উৎসাহিত করে। হোক না কম মানুষ, উপকৃত হচ্ছে, তাও হচ্ছে ত। সাধ্যের ভেতর অল্পই নাহয় করি। অন্তত যারা রিসোর্স খুজতেসে তারা নিরাশ না হোক। সম্পূর্ণ বাংলায় তাদের কাছে সব জানাটা থাকুক।
প্রিভিলেজ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের আরো বেশি করে সহায়তা করার জন্য বেশকিছু ইনিশিয়েটিভ ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে যা এবছরের শেষ নাগাদ, পাবলিক করে দেয়া হবে। সেটা সফল হলে, আরো বড় করে নতুন রূপে পাওয়া যাবে, অলিম্পিয়াড পিনবোর্ডকে।
সেই আশা , স্বপ্ন নিয়েই আমাদের সকল শুভাকাঙ্খীদের অসীম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, টিম ফাইন পাই। 



No comments:

Powered by Blogger.