কাব্যকথা

শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমার চাদ তখন আকাশে। কিছু মেঘের ভেলা চাদকে নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। আমি তখন ছাদের কিনারে একা বসে নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দেবার প্রচেষ্টায় মগ্ন। একটি কবিতা মনে মনে গড়েও ফেলেছিলাম। কিন্তু কবিতাটির সাথে সময় কিংবা পরিবেশের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এইসময় এই কবিতা মাথায় আসার কারণটাই বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় হঠাৎ নীরু উঠে আসলো ছাদে। আমার পাশে বসে প্রশ্ন করলো,
ঃ কি করছ?
ঃএইতো। একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছিলাম।
ঃ কি কবিতা? শোনাও দেখি।
ঃ উটকো একটা কবিতা। শুনলে তুমি আমাকে ছাদ থেকেও ফেলে দিতে পারো।
ঃ কি যে বলনা! তোমার সব কবিতাই আমার ভালো লাগে ।
প্রেয়সী আমার নাছোড়বান্দা। কবিতা না শুনে ছাড়বেনা খুব ভালো করেই জানা ছিল। তাই বাধ্য হয়ে শুরু করলাম কবিতা,

"রাজদরবারে গিয়ে দেখে বোকারাম
দেয়ালে মস্ত ছবিতে ঝুলে ভগবান
সেই ছবি দেখে বুঝে যায় বোকারাম
তাদের এ বংশপুরে রাণী বড় মহান
তাই সে রাণীর কাছে সব কথা কয়
কেন সে না খেয়ে মরে,খাজনা না দেয়,
"বহুদিন হলো গরু দুগ্ধ না দেয়
গরুরই বা দোষ কি? ঘাস নাহি পায়"
এই কথা শুনে তো উজিরের ওঠে রাগ
বংশপুরেতে নাকি ঘাসের অভাব!
বংশপুরের সব মাঠেঘাটে বাশের বাগান
বাশও যে ঘাসের জাত বলেছে বিজ্ঞান।
উজির বলে না ভুল বোকারাম জানে
উজির যে মহাজ্ঞানী সে কথা সে মানে
তাই সে গরুরে শুধু বাশ দিয়ে যায়
গরু মরে ভুত হয়,বাশ রয়ে যায়,
ক্ষুধার চোটেতে বোকা নিজেই তা খায়।"

কবিতা শেশে নীরুর দিকে তাকাতেই এক প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে যায়। "এসব কি ছাইপাঁশ লিখো আজকাল। পূর্ণিমা রাতে কোথায় রোমান্টিক কিছু লিখবে, তা না, কিসব বোকারাম, রাজা, উজির আবোলতাবোল লিখতে শুরু করেছ।" ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব চলাকালীন চুপচাপ ঘরে বসে থাকাই শ্রেয়। কবি তাই নির্বাক রয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে নীরু নিজেই বলে উঠলো, " আচ্ছা, তোমার ডায়েরিটা সাথে আছেনা? কালকে যে কবিতাটা লিখেছিলে ওইটা তো শোনা হয়নি ওইটা শোনাও।" এই কথা শুনে ভয়ে আমার হৃদস্পন্দন এতটা বেড়ে যায় যে আমি নিজেই তা শুনতে পাচ্ছিলাম। কারণ এতক্ষণ যে ঘূর্ণিঝড় চলছিল ওই কবিতা শুনলে তা টর্নেডোতে পরিণত হবে। আমি তাই ভয়ে কাচুমাচু হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, "ওইটা না শুনলে হয়না? তার চেয়ে ভালো আমরা বরং নীরবে বসে বসে চাদ দেখতে পারি।" কিন্তু ওই যে বললাম নীরু নাছোড়বান্দা। একবার যখন বলেছে না শুনে ছাড়বেনা। আর অন্য কবিতা দিয়েও যে বিপদ কাটিয়ে যাবো তাও সম্ভব না। কারণ আমার সব কবিতাই নীরুকে শোনানো হয়ে গেছে। তাই আবারও বাধ্য হয়েই বলতে শুরু করলাম,

"অরাজকতার রাজ্যে প্রতিদিন নানান জড়তা আঁকড়ে ধরছে আমায়,
আমি সেই জড়তা থেকে মুক্তি চাই।
দুর্বোধ্যের আবির মেখে,
আমি আবার ফিরে যেতে চাই অবাধ্যতায়।
কোনো এক নীল কিশোরীর বুকে জায়গা করে নেয়ার আনন্দটুকু ফিরে পেতে চাই,
সদ্য প্রস্ফুটিত একটি রক্তজবা তার হাতে দিয়ে,
ভালবাসি বলার সাহসটুকু আমার চাই।
নৈরাশ্যের ভাবনা থেকে মুক্তি নিয়ে,
প্ল্যাটনিক ভালবাসার বিচ্ছিন্ন স্বপ্নগুলোয় মগ্ন হয়ে আমি ঘুমোতে চাই।
অধরা যত স্বপ্ন আছে সব ভুলে যেতে চাই,
অধরে অধর রেখে ব্যারিকেড গড়ে,
বন্ধ করতে চাই তাদের ফেরার পথ।
কারও হাতে হাত রেখে আমি আধার ভুলতে চাই,
আমি আরও একবার কারও প্রেমিক হতে চাই।"

এই কবিতা শেষ হওয়ার পর কি হতে পারে তা আগেই বলে ফেলেছি। সেই মতো শুরু হয় টর্নেডো, " এখন তোমার কিশোরী লাগবে তাই না? আমি তো পুরনো হয়ে গেছি, নতুন প্রেমিকা লাগবে! নতুন করে প্রেমিক হবা!" আমি এবারও আগের মতোই চুপ। কিছুক্ষণ পর যখন শান্ত হয়েও রাগ করে বসে রইল আমি তখন বলতে শুরু করলাম,

"আজ হতে বহুবছর আগে,
জীবনানন্দ তোমায় দেখে ডেকেছিল বনলতা।
তারপরে কত কবি
কতভাবে বলে গেছে কতশত চারুকথা।
তবুও ফুরোয় না কথা।
তুমি যে প্রেয়সী ওগো, তুমি যে মুগ্ধতার ধারা,
তোমার চোখেতে চেয়ে, কবির কলম দিশেহারা।
তোমার ওই লাল ঠোঁটে পদ্মরা মুক্তা ফুটায়,
তোমার ওই খোলা চুল ঝর্ণারে অঝোরে ঝরায়।
তোমার শাড়ির আঁচলে আকাশও বিলীন হতে চায় ,
তুমি যদি হাসো তবে হাজারো কবিতা লেখা যায়।
আমারও সেই কবি হওয়াই সাধ,
একটু করুণা করো দান,
মুখে শুধু হাসি রাখো , সাজাবো কবিতার বাগান।"


কবিতা বলা শেষ হওয়ার পরে কিছুটা নীরব সময় কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর আমার একটা হাত জাপটে ধরে আমার কাধে মাথা রাখে নীরু। নীরবতা ভেঙে আমি প্রশ্ন করি, " ভালোবাসো?" উত্তরটা শোনার আগেই হঠাৎ বজ্রপাতের এক প্রকান্ড শব্দ আমার কানে আসে এবং আমায় বাধ্য করে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতে।

No comments:

Powered by Blogger.