দু'হাজার মাইল

"আমি ঝ’রে যাবো- তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেদিন পৃথিবীর ‘পরে
-আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।"
-জীবনবাবু

গান না হলেও এ গদ্য তোমাকে লক্ষ্য করে।

দু'হাজার মাইল দেশভ্রমন করে এখন একটু স্থুত হয়েছি। সঞ্জীবদার মতো কেউ আমাকে ভ্রমনবৃত্তান্ত লিখতে অনুরোধ করে নাই। অথবা, বয়সের ভার কলম, খাতা কিংবা পাঠকের উপর ঝাড়ব এমনো হয় নাই। লিখে সময় কাটানো ভালো বলে লিখছি। ভবিষ্যতের পাঠক, আমার এ খামখেয়ালীপনা ক্ষমা করতে পারেন।

খুলনা

একদা আমি খুলনা গিয়েছিলাম। দিনের বেলা স্বচক্ষে যা দেখেছি, তাই বর্ননা করব। কেননা, আমার খেয়াল হলো, আলোতে দেখতে হয়। অন্ধকার ভাবার জন্য। দিনের আলো যখন ফোটে আমি নওয়াপাড়া এলাকায়। শীতকাল তার বার্তাবাহককে পাঠিয়েছে। বার্তাবাহক এখনো আসতে আগ্রহী না বলে অল্প কিছু শিশির হয়ে ধানক্ষেতের ঠোটে বসেছে। ভৈরব নদীর পাশ দিয়ে আমাদের যাত্রা। আকিজ গ্রুপের বিশাল শোরুম দেখলাম। বুঝলাম,  শহরে আছি। এমন শহর যেন ঢাকার মতো নষ্ট না হয়।  চলার পথে জুট ও লবন মিলও দেখেছি। যেতে পথে খুলনা ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে যেতে হয়। কুয়েটে যখন পৌছালাম, তখন সাড়ে সাতটার মতো বাজে। কুয়েটের গেইট টা সুন্দর। ভিতরে ঢুকলে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যাবে ছোট কৃত্তিম টিলার উপর কুয়েট লেখা। গেইট থেকে সুদীর্ঘ রাস্তা ধরে একপাশে হল, আরেক পাশে কুয়েটের মাঠ রেখে আমার গন্তব্য তখন কুয়েটের মসজিদের দিকে। মসজিদ যে কতটা সাহায্য করে, এ দীর্ঘ ভ্রমনে টের পেয়েছি। খান জাহান আলী হলের পাশেই বড় পুকুর। খাজার পুকুর। মসজিদে নাস্তার ব্যবস্থা ছিল। খুলনার পানি লবনাক্ত। পানি নয় এ যেন শরবত। কুয়েট ঘুরে দেখলাম। অসাধারণ সুন্দর। পরবর্তীতে স্বীদ্ধান্ত হয়, কুয়েটই আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়। কুয়েটের কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সেন্টারের সামনে পদ্ম পুকুর আছে। পদ্ম তো আছেই, আমার ধারনা পুকুরে মাছ ও আছে।
পরীক্ষা শেষে আমাদের ফেরার যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায়, বাস ছাড়ার মিনিট খানেক পরই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। যখন ঘুম ভাঙ্গে বাস খুলনা সিটি বাইপাস ধরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পার করে এসে গেছে। ময়ুর নদী পার হয়ে কিছুক্ষন পর আসে খান জাহান আলী ব্রিজ। নিচে রূপসা নদী। ব্রিজ পার হয়ে এসে গেলাম বাগেরহাট জেলায়। কাটাখালি এলাকায় এসে দুটা ভিন্ন রাস্তা যায়। একটা মংলার দিকে যেখান দিয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায়। আরেকটা বাগেরহাট ষাট গম্বুজের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের গন্তব্য গোপালগঞ্জ এর দিকে,আমাদের পথ আরেকটা। বাগেরহাট-গোপালগঞ্জ রোডের দুপাশ অসাধারন সুন্দর। নারিকেল, সুপারি, তাল,  বাশ গাছের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি মনে হলো। ফকিরহাট এলাকা ধরে সামনে এগুলে কেন্দুয়ার বিল দেখা যায়। বিলে ছোট ছোট পুকুর কাটা। পুকুরে সম্ভবত মাছ চাষ করা হয়। পুকুরের পাড় খুবই সরু। সরু পাড়েই তাল গাছ লাগানো। মোল্লাহাট এলাকা পার হয়ে কালিগঙ্গা নদী পার হলেই গোপালগঞ্জ জেলা।
রোড থেকেই দূরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায়। এক যায়গায় বাসবিরতি দিলে খাওয়ার জন্য রাস্তার পাশেই এক দোকানে যাই। এখানে ঢাকার দিকে বেসন ও চিংড়ির খোসা দিয়ে যে খাদ্যবস্তু তৈরি করা হয়, গোপালগঞ্জে ব্যবহার করা হয় হেলেঞ্চা। খেতে দারুন। পাশে কালীগঙ্গা নদী রেখে আমরা টেকেরহাটের দিকে এগুই। টেকেরহাট এসে কালীগঙ্গা কুমার নাম নিয়েছে। কুমার নদের উপর সুন্দর একটা ব্রিজ আছে। ততক্ষনে সন্ধ্যা পরে গেছে। তাই পূর্বশর্তমতে অন্ধকার বর্ণনা নিষেধ। তবে না বললেই নয়, বাস যখন মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি, জানা গেল মাওয়া ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ। অগত্যা, আমাদের বাস আরিচা ঘাটের দিকে এগুলো। তার পরপরই, আমি ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে পরি। ঘুম যখন ভাঙে আমি ফেরিতে। মধ্যরাতে হালকা কুয়াশায় পদ্মার রহস্যভরা দিগন্ত, মাথার উপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, ফেরির মার্কিং বাতির আকর্ষণে শত শত জোনাকি পোকার ছুটে আসা, কৃত্রিম ঢেউ। এ যেন এক অসাধারণ অনুভূতি। এমনই কিছু কিছু সময় মনে হয়, জীবনের মানে ছুটে চলা নয়, শান্তভাবে বয়ে চলা।

রাজশাহী

ভোর যখন হলো, ব্লাড প্রেসার তখন হাই। দুঘন্টা ধরে জ্যামে বসে আছি। নাটোর আর পুঠিয়ার মাঝে একটা জায়গা। বিকল্প কিছু পাচ্ছি না বলে, বাস ছেড়ে যেতেও পারছি না। শেষ পর্যন্ত সাহস করে বাস থেকে নেমে সামনে এগুলেই বুঝলাম ঘটনা। মরিচের ট্রাক পুলিশ হেফাজতে। ধরা পরেছে অথবা এক্সিডেন্ট করেছে। তবে রাস্তার অর্ধেক খালিই ছিল। কিন্তু পুলিশ কোনো যানবাহন যেতে দিচ্ছে না। দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর কে নিজেদের সমস্যা বলতে যে অভদ্রতাসূচক উত্তর আসলো তা বাংলাদেশের পুলিশ থেকেই পাওয়া সম্ভব। শেষমেশ, ছাড়া পেলাম। রুয়েটে যখন পৌছাই, তখন হাতে আধ ঘন্টা। পরীক্ষা দিয়ে রুয়েট বাস টার্মিনালের দিকে যাওয়ার সময় শহর দেখছিলাম। শহরের সংজ্ঞা সেখানে কতটা ভিন্ন বুঝলাম। বাসের টিকিট নেই জানিয়েও গিয়েই টিকিট পেলাম। বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। রোডগুলো তুলনামূলক সরুই আমার কাছে মনে হলো। কর্তৃপক্ষ ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়া আর কিছুর খবর রাখে না। তবে দারুন জিনিস হলো, হাইওয়ের একসাইডে একটু নিচুতে লোকাল চলাচলের রাস্তা আছে। তবে দিনের ব্যস্ত সময়েও আমি লোকাল রোডে তেমন যানবাহন, মানুষ দেখলাম না। এদিকের মানুষের স্বভাব, রোডের কাছাকাছি বাড়ি থাকা। সেখানে হাইওয়ের দুপাশে কম হলেও এক কিলোমিটার দূরে গ্রামগুলো। এই মাঝখানের জায়গাটা ধানের বিল। সোনালী ধানে ছেয়ে আছে। বিলের মাঝখানে এক-দুই জায়গায় ছোট ছোট পুকুর দেখা যায়। পুকুরের চারপাশে তালগাছ। এগুলোই চোখের শান্তি। পুঠিয়া এলাকায় এসে কিছু রোডসাইন দেখে বুঝলাম এদিকে কোনো পুরাকীর্তি আছে। পুঠিয়া রাজবাড়ী। বরাল নদীতে দেখলাম, নদীর পানি অত্যন্ত ঘোলা। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল। বনপাড়া মোড় ঘুরে কিছুদূর এগুলোই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা গেল। বিশাল বিল, বিলে পানি আছে। সোনা ধান তো আছেই। এই কয়েক কিলোমিটার অবাক করবেই। মাঝখানে আত্রাই নদী পরে। নলকা বাজারের কাছে একটা নদী আছে। বাঙালি নদী। কোনোদিন এ নদীতে গোসল করে শুদ্ধ বাঙালি হব। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর আসে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যমুনা। যমুনা নদীর বিশালতার আয়োজন অনেক দূর থেকেই বুঝা যায়। রাস্তার ডানে নতুন রোডের কাজ, বামে বিস্তর মাঠ, বনভূমি। ব্রিজে উঠলে ডানপাশে দেখা যাবে বিস্তর চর। ধবধবে সাদা চর। কোনো মানুষ নেই। এক্কেবারে মরুভূমির স্বাদ। জীবনে একবার হলেও এই চরে নামব। ব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর এলেই বুঝা যাবে এপার আর উপার ঠিক এক না । ওপারের জন্য রীতিমত হাহাকার জাগবে। এলেঙ্গার পর বংশাই নদী। এরপর সূর্যের ধীরে ধীরে দিগন্ত ছোঁয়ার খেলার সাথে তাল মিলিয়ে আমি আমার যাত্রাপথ নরক-নগরীর দিকে এগুতে থাকি।

সিলেট

কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর পর পুকুরপুরের আড়িয়াল খাঁ নদের আগের পথ আমাকে মোটেও আকর্ষণ করেনি। তারপরের অনেক পথও না। রাস্তার পাশেই নগরায়ন দেখতে সুন্দর দেখায় না। চোখ বিস্তর মাঠ দেখতে চায়। সবুজ দেখতে চায়। হ্যা, এইটুকু পথের অনেক জায়গায়ই বিস্তর মাঠ। মাঠে ধান অথবা অথবা অন্য ফসল এর সৌন্দর্য আছে। কিন্তু নগরায়নের নান্দনিক দূষণ এরাই বা কত পরিষ্কার করতে পারবে!  তবে শিবপুর বাজারের কাছাকাছি আড়িয়াল খাঁ'র একটা শাখা দেখে বিস্মিত হই। রোডের ডান পাশে নদের ভালোই প্রবাহ আছে কিন্তু বাম দিকে নদের অস্তিত্ব নজরের আসলো না। ব্রিজের নিচেই নদের গলা টিপা হলো কি না কে জানে। তারপর অনেকটা পথ এরকম। অনেকটা বিস্তর মাঠ, মাঝে মাঝে রাস্তার একপাশ অথবা দুপাশে বাজার। দূর, কাছের গ্রামের সাথে হাইওয়ের সংযোগ সড়ক। আবার অনেকটা বিস্তর মাঠ। জগন্নাথপুর ব্রিজের নিচের ব্রহ্মপুত্র নদ এই ক্রম ভাঙার মহৎ কাজ করে। ভৈরব ব্রিজের আগ পর্যন্ত আবার নগরায়নের নান্দনিক দূষণ। ভৈরব ব্রিজ, এর পাশের রেললাইন, নিচের মেঘনা নদী কম্বিনেশন অসাধারণ। পথে রাইসমিলগুলোতে কোন আকৃতির অনেকগুলো বস্তু সারিভাবে রাখতে দেখলাম। ইটের ভাটার আকৃতির সদৃশ কিছুও আছে।
পূর্বের ক্রম আবার ভাঙল তিতাস নদী। তিতাস নদীর পর অনেকদূর মাঠগুলো কর্দমাক্ত, ভেজা মনে হলো। আরো অনেকটা জুড়ে অল্প পানির বিল। নোয়াপাড়ার পর এই পথের আসল সৌন্দর্য চোখে পরল।দূর পাহাড়। সাতছড়ির টিলাগুলো এখানে আসতে আসতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। বাঙালি একটু উঁচু জায়গা দেখলেই পাহাড়সম আনন্দ পায়। আমিও যে কম আনন্দ পেয়েছি তা নয়। টিলাগুলো প্রচুর সবুজ। কিছুটা সাতছড়ির স্বাদ ও পাওয়া যেতে পারে। ডানে সবুজ টিলা, বামে সমতলের বিস্তর মাঠ। সৌন্দর্য বর্ণনাতীত।
হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পর কিছুটা জায়গাতে উভয় পাশেই টিলা। এগুলাই রাস্তার খুব কাছাকাছি। মনে হয় যেন, টিলা কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। বনভূমি ছেড়ে সমতলতে এসে প্রথম দেখা হলো সুতাং নদী । কুটিরগাঁও এর কাছে খোয়াই নদীর উপর দারুন একটা ব্রিজ আছে। বাহুবলের পর আছে কোরাঙ্গি নদী। পুটিজুরির পর ডানদিকে কিছুদূর বনভুমি দেখা যায়। বিজনা নদী এ ধারা ভাঙ্গে। এ পথে ডানদিকে যত জমি দেখলাম সেখানে সবজি যেমন সিম, ফুলকপি এগুলোই বেশি চাষ করতে দেখলাম। পিঠুয়ার পর বেড়ী বিল আছে। শেরপুর ব্রিজটাও অসাধারণ। নিচে কুশিয়ারা নদী। সাদিপুরে কুশিয়ারার আরেকটা শাখা আছে। ব্রিজটাও আগেরটার মতো। ম্যাপ দেখালো এটা মৃত নদী। আমার কাছে এমন মোটেও মনে হলো না। সিলেট  আসতে আসতে সন্ধ্যা। কদমতলী থেকে রিক্সা নিই। ক্বীন ব্রিজ, নিচে সুরমা, ধরে রিক্সা এগুই। ব্রিজ খুব উচু বলে রিক্সা ঠেলা দেয়ার লোক লাগে। সিলেটে আমি সবচেয়ে বেশি লোক দেখেছি ক্বীনের উপরেই। ব্রিজ পার হয়ে সিলেটের ব্যাপারের আমার ধারনা বদলালো। রাতের সিলেটে ঢাকার স্বাদ পাওয়া যায়। ফুটপাতে জামা-কাপড় বিক্রি হচ্ছে। রিক্সায় বসে আমি হন্যে হয়ে যা খুজছি তা হলো বইয়ের দোকান। দুই-একটা স্টেশনারি ছাড়া আর কিছু দেখলাম না। রাতের সিলেটে ঢাকার মতোই রিক্সার আনাগোনা বেশি। চারপাশে আহামরি কিছু না থাকলেও অজান্তেই মনে মনে গেয়ে উঠলাম,
“এ শহর আমার, এ মানুষ আমার!”

No comments:

Powered by Blogger.